খোন্দকার কাওছার হোসেন : রাজনীতিতে চলছে লর্ড কারলাইল বিতর্ক। ব্রিটিশ এই আইনজীবীকে নিয়ে দেশীয় রাজনীতি এখন অনেকটাই তুঙ্গে। গত বুধবার রাতে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে তাকে লন্ডনগামী বিমানে ফেরত পাঠানোয় জমে ওঠেছে বিতর্ক। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ভারতীয় সরকারের এ কাজে সন্তষ্ট হলেও বিস্মিত ও মর্মাহত হয়েছে বিএনপি।
গত বুধবার রাতে বিমানযোগে দিল্লি ইন্দিরা গান্ধি বিমানবন্দরে পৌঁছলে ভারতে ঢুকতে না দিয়ে বিমানবন্দর থেকেই ফিরতি বিমানে তাকে তার দেশে পাঠিয়ে দেয় ভারতীয় সরকার। কার্লাইলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি টুরিস্ট ভিসায় ভারত এসেছিলেন। এই ভিসায় কোনও দেশে প্রবেশ করে সংবাদ সম্মেলন করার এখতিয়ার কারও নেই। এ কারণে তাকে ভারতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাভিশ কুমার বলেন, তিনি ভিসার আবেদনে সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে যা লিখেছেন, তার সঙ্গে তার তৎপরতা সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও খালেদা জিয়ার দ- নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দিল্লির লে মেরিডিয়ান হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন কারলাইল। সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন্ ছিল। ঢাকা থেকে বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্ত বাঁধ সাধে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত সরকারকে জানায়, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য না হলে বা সনদপ্রাপ্ত না হলে দেশের বাইরের কোনও আইনজীবী এদেশে এসে কারও পক্ষে আইনি সহায়তা দেয়ার আইনগত অধিকার রাখেন না। এ কারণে কার্লাইলকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেয়া হয়নি। বাংলাদেশে আসতে ব্যর্থ হওয়ায় লর্ড কার্লাইল ভারতে প্রবেশ করতে চায়-এটা জানানো হয় ভারতকে। ভারত সরকার বিষয়টি বুঝতে পেরে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে কার্লাইলকে ফেরত পাঠায়। কার্লাইলকে ঢুকতে না দেয়ার ভারত সরকারের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির দায়িত্বশীল নেতাদের ভাষ্য, একটি দেশের ভূখ- ব্যবহার করে আরেক দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের সুযোগ কেউ পেতে পারে না। এ কারণেই ভারতে তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, লর্ড কার্লাইল যে ইনটেনশন নিয়ে ভারতে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছেন সেটা নিয়মবহির্ভূত ছিল। এজন্যে ভারত সরকারকে আমরা সাধুবাদ জানাই। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেন, লর্ড কার্লাইলকে দিল্লি বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেয়ার খবর জেনে আমরা বিস্মিত হয়েছি। তাকে ভারতে প্রবেশ করতে না দেয়ায় আমরা মর্মাহত। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে মুক্তচিন্তা অনুশীলনের সঙ্গে এই ঘটনা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে আমরা মনে করি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার আপিল চলাকালে ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড কার্লাইল যদি কোনও বিরূপ মন্তব্য করেন, তবে তা আদালতের নজরে আনা হবে। কার্লাইল একজন হাই প্রোফাইল ল’ইয়ার। কিন্তু তিনি যে কাজটা করতে যাচ্ছেন, সেটা অত্যন্ত অসৌজন্যমূলক। তিনি ভারতে গিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের (বাংলাদেশের) বিচার ব্যবস্থা নিয়ে মন্তব্য করবেন, সমালোচনা করবেন, এটা কোনও সুস্থ-বিবেকবান মানুষ গ্রহণ করবে না। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। প্রখ্যাত আইনজীবী লর্ড আলেকজান্ডার কারলাইল যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের সদস্য। পাশাপাশি কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের চেয়ারম্যানও তিনি। যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের স্বাধীন পর্যবেক্ষক হিসেবে প্রায় এক দশক কাজ করা এই আইনজীবী ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্সের সাবেক প্রধান জন স্কারলেটের সঙ্গে মিলে এসসি স্ট্র্যাটেজি লিমিটেড নামে একটি পরামর্শ সেবা প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন, যা বছর তিনেক আগে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় আসে। কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনি পরামর্শক ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড আলেকজান্ডার কার্লাইলকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এ তথ্য গত ২০ মার্চ গণমাধ্যমকে অবহিত করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে মির্জা ফখরুলের এ ঘোষণার পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার সূত্রপাত হয়। বাংলাদেশে কারলাইল আলোচনায় আসেন ২০১৬ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায়ের পর বিবৃতি দিয়ে, যেখানে তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন। এ কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা কার্লাইলকে বর্ণনা করেন জামায়াতের লবিস্ট হিসেবে। খালেদা জিয়ার আইনী পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরই আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কার্লাইল বলেছিলেন, আইনের মানদ-ে নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে খালেদা জিয়ার সাজার রায় হয়েছে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য না হলে বা সনদপ্রাপ্ত না হলে দেশের বাইরের কোনও আইনজীবী এদেশে এসে কারও পক্ষে আইনি সহায়তা দেয়ার আইনগত অধিকার রাখেন না। এ কারণে কার্লাইলকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেয়া হয়নি। বাংলাদেশে আসতে ব্যর্থ হওয়ায় লর্ড কার্লাইল প্রতিবেশী ভারতকে বেছে নেয়। তিনি দিল্লীর ফরেন করেসপন্ডেন্ট ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করার প্রস্তুতি নেন। যে অনুযায়ি সময় ও তারিখ নির্ধারিত হয়। কিন্ত এক পর্যায়ে ফরেন করেসপন্ডেন্ট ক্লাব কর্মসূচি বাতিল করে। ফলে তার ভারত সফর অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে লর্ড কারলাইল লে মেরিডিয়ান হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করার প্রস্তুতি সেরে ফেলেন। এমনি কি তিনি ঘোষণা দেন দিল্লী আসছি, সংবাদ সম্মেলনও করবো। লর্ড কারলাইলের এমন দৃঢ় অবস্থানে অনঢ় হয়ে ওঠে বাংলাদেশ সরকার। কুটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে কারলাইলকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত যেতে বাধ্য করে। যাকে বিজয় হিসেবে মনে করছে বাংলাদেশের ক্ষমতাশীন দলের নেতারা। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, লর্ড কার্লাইলের উদ্দেশ্য ছিল ষড়যন্ত্র। ভারত সরকার তা বুঝতে সমর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা যেমন আমাদের ভূখ- ব্যবহার করে কাউকে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে দেই না, তেমনি ভারতও তাদের ভূখ- ব্যবহার করে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে দেয়নি কার্লাইলকে। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, খালেদা জিয়ার মামলায় লড়তে ঢাকায় আসার কথা ছিল লর্ড কার্লাইলের। সরকার তাকে বাংলাদেশের ভিসা দিল না। অথচ আগরতলা মামলায় লড়তে স্যার টমাস উইলিয়ামকে ঠিকই বাংলাদেশে এসে আইনি লড়াই করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এমন বৈষম্য কেন? সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে মঈন খান বলেন, লর্ড কার্লাইল তো খালেদা জিয়ার আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তাহলে তাকে কেন খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনি পরামর্শ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি? দেশের প্রত্যেকটি মানুষের গণতান্ত্রিক, আইনি সুবিধা পাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু খালেদা জিয়াকে সেটি দেয়া হচ্ছে না।
Leave a Reply